চার-পাঁচশো টাকায় প্রাইভেট পড়তো আমার বড় বুবু । এটা খুব প্রাচীন কেচ্ছা নয়। বড় জোড় ৫-৬ বছর আগের হবে।
আমার ছোটো বুবু পড়েছে ছয়-সাতশো টাকায় । আর এখন আমি পড়ছি হাজার টাকায় । আমার ছোটো ভাই এসে ১২০০ টাকায় পড়তে পারবে কিনা সন্দেহ ।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষকদের সম্মানী বেড়েই চলেছে । শুধু বাড়ছে না আমাদের বাবাদের বেতন ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, “প্রাইভেট কেনো পড়তে হবে ? আর প্রাইভেট যদি পড়তেই হয় তবে ক্লাস কেন ?”
উত্তর টা আমি আমার মফস্বল শহরের আলোকে দিতে চাই । ঢাকার নামি-দামি কলেজ গুলোর ক্লাসের খবর আমার জানা নেই ।
নিয়মিত ছাত্র হিসেবে আমাদের এই শহরের কলেজের ক্লাসরুম গুলোতে শৃংখলার বাহিরের পড়াশোনা খুব একটা শেখা হয় না ।যেটুক হয় ওতে এভারেজ মানের স্টুডেন্টরা পাশ করতে পারবে ঠিক – ভালো রেজাল্ট নয় ।
আমাদের শিক্ষকদের ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই । ৭০ জন ছাত্রের ক্লাস । সপ্তাহে ৩ টা পান । এই অল্প সময়ে অতিরিক্ত প্রাইভেটের যে চাহিদা সেটা মেটানো আদৌ সম্ভব কিনা জানি না । তবে সামান্যতমও মিটছে না ।
অনেক ছাত্রের অভিযোগ,
“প্রাইভেটে নেওনের লিজ্ঞা ভালা কইরা পড়ায় না।”
এ কথার সত্যতার ব্যাপারে আমি সন্দিহান। কারন আমি বিশ্বাস করি শিক্ষক মাত্রই দাতা।
তবে অনেক কে বলতে শুনেছি “এই নোট যেন প্রাইভেটের বাইরের কেউ না পায় ।”
গ্রামের কোনো ছোটো ভাই শহরে ভর্তির ব্যপারে কথা বলতে আসলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতে হয়, “বাবা প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা চালাতে পারবে তো ? নইলে সটকে পড়ো। পড়াশনা গরিবের জন্য না ।” শুনে মন খারাপ করলেও সত্যি এটাই ।
আমার দেখা কিছু শিক্ষক আছেন যারা আর্থিক সমস্যা গ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ফ্রিতেই পড়ান । আবার অন্যদেরকেও কিছু ছাড় দিতে অনুরোধ করতেন ।এভাবে আর্থিক সমস্যার কথা জানালে খরচে কিছুটা কমে আসে । তবে এই কথা তুলতে ছাত্রের আত্নসম্মানে কেমন লাগে তা আমার জানা নাই ।
“যার ৮০০ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আছে সেকি — হাজার টাকা দিতে পারে না ? পড়াশোনার ব্যাপারেই কেবল কমাতে আসে ।”
এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে ।
এই অতিরিক্ত দু-শো টাকার আড়ালে একজন মধ্যবিত্ত বাবার যে কিছু শখ-আহ্লাদ লুকিয়ে থাকে, সন্তানের মুখপানে চেয়ে অপূর্ণ শখ গুলো যে আর পূরণ করা হয় না — তা তাদের মাথার আসে না।
যুগের পরিবর্তনে আরো যে একটা বিষয় পরিবর্তিত হয়েছে সেটি হচ্ছে –শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা ।
সপ্তাহ খানেক আগে বাড়ি যাবার পথে একটা ঘটনা দেখলাম । অটোর সামনে বসে ছিলাম । ড্রাইভার অনেকটা স্লো করে হাত উচিয়ে রাস্তার ঐ পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধকে সালাম করলেন ।
অটোটা খানিকটা সামনে এগিয়ে এলে হেসে হেসে বলেন, “আমার স্যার — আমারে কতো কইছিলো ভর্তি হইয়া থাকতে খরছ হেইতে চালাইবো । আমি কেবল গিয়া পরীক্ষা দিতাম ।”
আমি উনার দিকে একটা বার তাকালাম । নিখাদ শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা মুখ ঠিকরে পড়ছে । দেখে অনাবিল প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেছিলো ।
স্রেফ উদাহরণের জন্য কাহিনীটা বলা। আরেকটা উদাহরণ দেই ।
কিছু ছাত্র দূর থেকে একজন শিক্ষককে দূর থেকে আসতে দেখে তড়িঘড়ি করে অন্য একটা গলিতে ঢুকে পড়ে। কারন হিসেবে জানা যায় — দেখা হইলে নাকি তিনি প্রাইভেটের কথা তুলবেন । আবার কাউকে বলতে শোনা যায়,
“শালায় এক নম্বরের মাদারচোদ, জায়গা মতো ভইরা দিবো।”
উপরের দুইটাই ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক —
একটা সেকালের, একটা একালের ।
কাল ভয়াবহ বদলেছে !
বদঅভ্যাসে কতো শাখা প্রশাখা ছড়াচ্ছে ।
মূল কথায় ফিরে আসি —
শিক্ষকরা আমাদের যেরকম পরিশ্রম করা পড়ান । তার তুলনায় পারিশ্রমিক একটুও বেমানান নয় । তবে আমাদের বাবাদেরও তো থাকতে হবে ।
আমার বিষয়টা ভিন্ন । টাকা চাইতে দেরি হয়, পাঠাতে দেরি হয় না। সরকারি চাকুরিজীবি বাবা আমার, সবার বাবাতো না ।
সকল শিক্ষকদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
প্রাইভেট সমাচার।
© মুহাম্মদ রাকিবুল হাসান।
৪ নভেম্বর ২০২০